কোরআনুল কারিমের অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা
সুরা : আনআম, আয়াত : ৯৫-৯৬
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে
اِنَّ اللّٰهَ فَالِقُ الۡحَبِّ وَ النَّوٰی ؕ یُخۡرِجُ الۡحَیَّ مِنَ الۡمَیِّتِ وَ مُخۡرِجُ الۡمَیِّتِ مِنَ الۡحَیِّ ؕ ذٰلِكُمُ اللّٰهُ فَاَنّٰی تُؤۡفَكُوۡنَ ﴿۹۵﴾
فَالِقُ الۡاِصۡبَاحِ ۚ وَ جَعَلَ الَّیۡلَ سَكَنًا وَّ الشَّمۡسَ وَ الۡقَمَرَ حُسۡبَانًا ؕ ذٰلِكَ تَقۡدِیۡرُ الۡعَزِیۡزِ الۡعَلِیۡمِ ﴿۹۶﴾
সরল অনুবাদ
(৯৫) নিশ্চয় আল্লাহ শস্যবীজ ও আঁটিকে অঙ্কুরিত করেন। তিনিই প্রাণহীন হতে জীবন্তকে নির্গত করেন এবং জীবন্ত হতে প্রাণহীনকে নির্গত করেন। তিনিই তো আল্লাহ। সুতরাং তোমরা কোথায় ফিরে যাবে?
(৯৬) তিনিই ঊষার উন্মেষ ঘটান, আর তিনিই বিশ্রামের জন্য রাত এবং গণনার জন্য চন্দ্র ও সূর্যকে সৃষ্টি করেছেন, এ সব পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ কর্তৃক সুবিন্যস্ত।
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা
সুরা আনআমের ৯৫ নম্বর আয়াত থেকে মহান আল্লাহর অপরিসীম শক্তি এবং তাঁর কর্মক্ষমতার কথা আরম্ভ হচ্ছে। এখানে মহান আল্লাহ বলছেন, চাষিরা জমির নিচে যেই বীজ বা আঁটি মাটি চাপা দেয় মহান আল্লাহ তাআলা সেই বীজ ও আঁটি অঙ্কুরিত করে তা থেকে বহু প্রকার বৃক্ষ উদগত করেন। জমি একটাই এবং যে পানি দিয়ে তার সেচ করা হয় তাও একটাই, কিন্তু যে যে জিনিসের বীজ বপন করে অথবা আঁটি পুঁতে সেই অনুযায়ী মহান আল্লাহ বিভিন্ন প্রকার শস্যাদি ও ফল-মূলের গাছ সৃষ্টি করেন। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ এমন আছে নাকি, যে এ কাজ করে বা করতে পারে?
মহান আল্লাহ কর্তৃক বীজ বা আঁটি থেকে বৃক্ষ উদগত করার পর তাতে থাকে জীবন এবং তা বাড়ে, সম্প্রসারিত হয় এবং ফল অথবা শস্য দেয় কিংবা সেই দেয় সুগন্ধময় রকমারি ফুল; যা দেখে বা যার ঘ্রাণ নিয়ে মানুষ আনন্দ ও খুশী অনুভব করে।
অথবা বীর্য ও ডিম থেকে মানুষ ও জীব-জন্তু সৃষ্টি করেন।
আয়াতে এর পর বলা হচ্ছে “তিনিই প্রাণহীন হতে জীবন্তকে নির্গত করেন এবং জীবন্ত হতে প্রাণহীনকে নির্গত করেন”। যেমন- জীব-জন্তু থেকে ডিমকে; যা মৃত জিনিসেরই আওতাভুক্ত। আবার সেই ডিম থেকে জীবও সৃষ্টি করেন।
কোনো কোনো মুফাসসির এর মতে আয়াতে উল্লেখিত حي এবং ميت শব্দদ্বয় দ্বারা মুমিন এবং কাফের বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, মুমিনের ঘরে কাফের এবং কাফেরের ঘরে মুমিন সৃষ্টি করেন।
সুরার ৯৬ নং আয়াতে বলা হচ্ছে অন্ধকার ও আলোর স্রষ্টাও তিনিই। তিনি রাতের অন্ধকার থেকে উজ্জ্বল প্রভাত সৃষ্টি করেন। ফলে প্রতিটি জিনিসই আলোকিত হয়ে যায়।
আবার রাতকে অন্ধকার দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন, যাতে মানুষ উজ্জ্বলতার সমস্ত ব্যস্ততাকে দূর করে বিশ্রাম নিতে পারে।
৯৬ নং আয়াতে فَالِقُ শব্দের অর্থ ফাঁককারী এবং إصباح শব্দের অর্থ প্রভাতকাল। (فَالِقُ الْإِصْبَاحِ) এর অর্থ প্রভাতের ফাঁককারী; অর্থাৎ গভীর অন্ধকারের চাদর ফাঁক করে প্রভাতের উন্মেষকারী। (তাফসিরে জালালাইন) এটিও এমন একটি কাজ, যাতে জ্বিন, মানব ও সমগ্র সৃষ্ট জীবের শক্তিই ব্যর্থ। প্রতিটি চক্ষুষ্মান ব্যক্তি এ কথা বুঝতে বাধ্য যে, রাত্রির অন্ধকারের পর প্রভাতরশ্মির উদ্ভাবক জ্বিন, মানব, ফিরিশতা অথবা অন্য কোনো সৃষ্টজীব হতে পারে না, বরং এটি বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ্ তাআলারই কাজ। তিনি ধীরে ধীরে অন্ধকার চিরে আলোর উন্মেষ ঘটান। সে আলোতে মানুষ তাদের জীবিকার জন্যে বের হতে পারে।
এরপর বলা হচ্ছে- আল্লাহ্ তাআলা সূর্য ও চন্দ্রের উদয়-অস্ত এবং এদের গতিকে একটি বিশেষ হিসাবের অধীনে রেখেছেন। এর ফলে মানুষ বৎসর, মাস, দিন, ঘণ্টা এমনকি মিনিট ও সেকেণ্ডের হিসাবও অতি সহজে করতে পারে। আল্লাহ্ তাআলার অপার শক্তিই এসব উজ্জ্বল বিশাল গোলক ও এদের গতি-বিধিকে অটল ও অনড় নিয়মের অধীন করে দিয়েছে। হাজার হাজার বছরেও এদের গতি-বিধিতে এক মিনিট বা এক সেকেণ্ডের পার্থক্য হয় না। এ উজ্জ্বল গোলকদ্বয় নিজ নিজ কক্ষপথে নির্দিষ্ট গতিতে বিচরণ করছে। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, “সূর্যের পক্ষে সম্ভব নয় চাদের নাগাল পাওয়া এবং রাতের পক্ষে সম্ভব নয় দিনকে অতিক্রমকারী হওয়া। আর প্রত্যেকে নিজ নিজ কক্ষপথে সাতার কাটে।” (সুরা ইয়াসীন, আয়াত: ৪০)
পরিতাপের বিষয়, প্রকৃতির এ অটল ও অপরিবর্তনীয় ব্যবস্থা থেকেই মানুষ প্রতারিত হয়েছে। তারা এগুলোকেই স্বয়ংসম্পূর্ণ বরং উপাস্য ও উদ্দিষ্ট মনে করে বসেছে। যদি এ ব্যবস্থা মাঝে মাঝে অচল হয়ে যেত এবং কলকব্জা মেরামতের জন্য কয়েকদিন বা কয়েক ঘণ্টার বিরতি দেখা দিত, তবে মানুষ বুঝতে পারত যে, এসব মেশিন আপনা আপনিই চলে না, বরং এগুলোর পরিচালক ও নির্মাতা আছে। আসমানী কিতাব, নবী ও রাসুলগণ এ সত্য উদঘাটন করার জন্যই প্রেরিত হন। কোরআনুল কারীমের এ বাক্য আরো ইঙ্গিত করেছে যে, বছর ও মাসের সৌর ও চান্দ্র উভয় প্রকার হিসাবই হতে পারে এবং উভয়টিই আল্লাহ্ তাআলার নেয়ামত। এর মাধ্যমেই সময় ও কাল নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে। এতে এক দিকে যেমন ইবাদতের সময় নির্ধারণ করা যায়, অপরদিকে এর মাধ্যমে লেন-দেনের সময়ও ঠিক রাখা যায়। তাছাড়া কতটুকু সময় পার হয়েছে আর কতটুকু বাকী রয়েছে সেটা জানাও এ দুটোর কারণেই হয়ে থাকে। যদি এগুলো না থাকত, তবে এ সময় নির্ধারণের ব্যাপারটি সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকত না। এর জন্য বিশেষ শ্রেণীর প্রয়োজন পড়ত। যাতে দ্বীন ও দুনিয়ার অনেক স্বার্থ হানি ঘটত।
এ বিস্ময়কর অটল ব্যবস্থা- যাতে কখনো এক মিনিট ও এক সেকেণ্ড এদিক-ওদিক হয় না- এটি একমাত্র আল্লাহ তাআলারই দুটি মহান গুণ অপরিসীম শক্তি ও অপার জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ। এজন্যেই বাক্যের শেষে আল্লাহর দুটি গুণ বাচক নাম পরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী’ উল্লেখ করা হয়েছে। তার অপার শক্তির কারণে সমস্ত কিছু তার অনুগত বাধ্য হয়েছে। আর তার পরিপূর্ণ জ্ঞানের কারণে কোনো গোপন বা প্রকাশ্য সবকিছু তার আয়ত্বাধীন রয়েছে।
সৌজন্যে কালের কণ্ঠ